মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত জীব । সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ নানান বৈরি পরিবেশ মোকাবেলা করে পথ চলেছে। নিজস্ব বাস্তবতায় সর্বোচ্চ সুবিধাকে কাজে লাগানোর জন্য মানুষ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টার। সফলতা- বিফলতার ধারায় সফলতা অর্জন করেই এগিয়ে গেছে মানুষ। নিত্য-নতুন সৃষ্টি আর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জীবনকে করেছে সুষমামণ্ডিত । তাই উদ্যোগ মানব জীবনের শুরু থেকেই বর্তমান ছিল- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না । তবে ব্যবসায় উদ্যোগের শুরু হয়েছে বেশ পরে। ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশ নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. প্রাচীন যুগ (Ancient period) : মানুষ সংঘবদ্ধ হওয়ার পর নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির ও একত্রে প্রয়োজন পূরণের জন্য চাষবাস, পশুপালন, পশুশিকার, মাছশিকার-এভাবে নানান উপজীবিকা গ্রহণ করে । নিজেদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন অন্যের সাথে বিনিময়ের ব্যবস্থা করে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা চালায় মানুষ। ধীরে ধীরে কামার, কুমার, তাঁতী-এভাবে নানান সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এ সকল কাজ যে মানুষের নতুন চিন্তা ও উদ্যোগের একেকটা ফসল তা বলার অপেক্ষা রাখে না । সমাজ আরও সংহত হলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ঘটে । এতে মুদ্রা দিয়ে কেনা- বেচা শুরু হওয়ায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয় । একক মালিকানার ভিত্তিতে নানান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে । নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটে । ব্যবসায় বড় হওয়ায় যৌথ সামর্থ্যের সম্মিলনে অংশীদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ প্রাচীন যুগেই বিস্তৃতি লাভ করে । তবে ব্যবসায় উদ্যোগ একটা আলাদা বিষয় হতে পারে তা মানুষের চিন্তায় তখনও স্থিতিলাভ করেনি।
২. মধ্য যুগ (Middle age): যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক ধারাতেই বিকাশ লাভ করে। বণিক শ্রেণি পালতোলা নৌকায় বা উটের পিঠে পসরা সাজিয়ে একস্থান থেকে অন্যত্র মালামাল বেচা-কেনা করলেও ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইতালিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুনভাবে বিকশিত হলে উৎপাদনের পদ্ধতিগত উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায় বিকাশ লাভ করে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে। সপ্তদশ শতকে এসে ইউরোপের আরও কিছু দেশ ব্যবসায়ে উন্নতি লাভ করলে বৈদেশিক ব্যবসায়ে ত প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ফলে ব্যবসায় বা শিল্প-বাণিজ্য অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এর সুবাদে ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা মানুষের মনে স্থান নিলেও তা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়নি ।
৩. আধুনিক যুগ (Modern stage): আধুনিক যুগ বলতে অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব শুরুর পর থেকে সমসাময়িক কালকে বুঝায় । যান্ত্রিক শক্তির উন্মেষ এ সময়ে শিল্প বিপ্লবে মুখ্য ভুমিকা রাখে । এই যান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ছিল সেই সময়ের এক অপরিহার্য দাবি। কারণ কায়িক শ্রম এবং পশুশক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যবসায় উন্নয়নের তৎকালীন গতিধারার সাথে সংগতি বিধানে সক্ষম ছিল না। বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই চাহিদা পুরণে অনেকেই নতুন নতুন ব্যবসায় গড়ে তা পূরণের চেষ্টা চালায় । ফলে ব্যবসায় উদ্যোগ বা নতুন ব্যবসায় গড়ার ভাবনা সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ প্রেক্ষিতেই 'ব্যবসায় উদ্যোগ' বা 'শিল্পোদ্যোগ' ধারণা আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় । এই পর্যায়ে উক্ত বিষয়ে ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
- অষ্টাদশ শতক (18th century): এই শতককে উদ্যোক্তা বা Entrepreneur শব্দের জনপ্রিয় হওয়ার সময়কাল হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সময়ে ফরাসি 'Entreprendre' শব্দ থেকে ইংরেজি 'Entrepreneur' শব্দ উদ্ভুত বলে মনে করা হয়ে থাকে। ফরাসি এ শব্দটি দ্বারা সংগীত বা বিনোদন প্রতিষ্ঠানের সংগঠককে বুঝানো হতো। অষ্টাদশ শতকের পূর্বে ইংরেজি Entrepreneur শব্দটি সংগঠক, আয়োজনকারী (to undertake) অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। একই শতকের ১৭২৫ সালে রিচার্ড, ক্যানটিন (Richard Cantillon) সর্বপ্রথম Entrepreneur' শব্দটি শিল্পোদ্যোগ বুঝাতে ব্যবহার করেন এবং উদ্যোগ শব্দটিকে অর্থনৈতিক কর্ম প্রচেষ্টা হিসেবে তুলে ধরেন। এ কারণেই তাকে 'শিল্পোদ্যোগ' নি পদবাচ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । তিনি সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শিল্পোদ্যোক্তাকে পৃথক' করেন । তিনিই সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে, শিল্পোদ্যোক্তাগণকে অনিশ্চিত পরিবেশে কার্য সম্পাদন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয় । ১৭০০ সালের পর শিল্প বিপ্লব শুরু হলে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিকীকরণের ব্যাপক প্রয়াস লক্ষ করা যায়। নতুন বাজার দখলের প্রচেষ্টায় উপনিবেশ সৃষ্টির প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়। ফলে শিল্পোদ্যোগ বা ব্যবসায় উদ্যোগ ধারণা অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
- উনবিংশ শতক (19th century): এই শতাব্দিতে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে বই পুস্তক লেখা হয় । এ সকল বই লিখতে যেয়ে অনেক লেখক ব্যৱস্থাপক, মালিক, উদ্যোক্তা প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গকে পৃথকভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পান। ফলে শিল্পোদ্যোক্তা বিষয়ক ধারণা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে । ১৮৩৫ সালে S. P. Newman (নিউম্যান) যে কোনো ব্যবসায়ের জন্য একজন ভালো উদ্যোক্তার কথা বলেন । তিনি বলেন, “তার মধ্যে এমন অনেক গুণের সমন্বয় ঘটবে যেমনটি একজন ব্যক্তির মধ্যে জাত সাধারণভাবে দেখা যায় না। তাকে অসাধারণ দূরদৃষ্টি, মাত্রাজ্ঞান ও বিবেচনা শক্তির অধিকারী হতে হবে, যেন তিনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাকে সহনশীলতা এবং উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা অবশ্যই দেখাতে হবে। J. S. Mill (মিল) তাঁর লেখনীতে উদ্যোক্তার আরো দু'টি গুণের কথা উল্লেখ করেন, আর তা হলো কর্তব্য পরায়ণতা ও উৎসাহ। এভাবেই এই শতকে ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপক বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি ব্যবসায় উদ্যোগ ও শিল্পোদ্যোক্তা বিষয়ক আলোচনা গুরুত্ব লাভ করে ।
- বিংশ শতক (20th century): বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ এ. স্যূমপিটার (Joseph A. Schumpeter) শিল্পোদ্যোগ ধারণায় পরিমার্জন করেন । তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদ্যোক্তার গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “উদ্যোক্তা এমন একজন ব্যক্তি যিনি সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন ও উন্নয়নে গতিশীলতা সঞ্চার করেন।" তিনি আবিষ্কারক ও উদ্ভাবনকারীর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন এবং মনে করেছেন, একজন -উদ্যোক্তা নতুন ধারণা আবিষ্কার করেন এবং তার সফল প্রয়োগে উদ্ভাবনকারীর দায়িত্ব পালন করেন । তাঁর মতে, “ব্যবস্থাপকগণ সংগঠনের দৈনন্দিন কাজ তদারক করেন। আর শিল্পোদ্যোক্তা উৎপাদনের উপকরণসমূহের সংমিশ্রণের মাধ্যমে নতুন পণ্য, ধারণা ও বাজার সৃষ্টি করেন।” রিচার্ড টি এলি (Ely) এবং রেল এইচ হোস (Hess) ১৯৩৭ সালে লিখেন যে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য শিল্পোদ্যোক্তা একটি প্রতিষ্ঠান সংগঠিত ও পরিচালনা করেন এবং তিনি ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অনিয়ন্ত্রণমূলক পরিচিতি থেকে উদ্ভূত লাভ বা ক্ষতি গ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দির শেষ দিকে এসে আচরণ বিজ্ঞানী ও সমাজ তত্ত্ববিদগণ উদ্যোক্তার উন্নয়ন ও ভূমিকার উপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন ও তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছেন। এদের মধ্যে ডেভিড সি ম্যাকক্লিল্যান্ড (McClelland), এভারেট ই হ্যাগেন (Hagen), থমাস কোচরান (Cochran), ফ্রাঙ্ক ইয়ঙ্গ (Young) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক কালে পিটার এফ. ড্রাকার (Drucker), এলবার্ট শ্যাপেরো (Shapero), জি পিনচুট (Pinchot), বরার্ট হিজরিচ (Hisrich), এ্যালান এইচ. এ্যানডারসন ( Anderson ) প্রমুখ লেখক ও পন্ডিতগণের গবেষণা ও লেখনী শিল্পোদ্যোগ ধারণার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে ।
উদ্যোগ ধারণার ক্রমবিকাশের আলোচনা শেষে সংক্ষেপে বলা যায়, সমাজ উন্নয়নের সাথে উদ্যোগ ধারণা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। তবে ব্যবসায় উন্নয়নের ধারা যত দ্রুততর হয়েছে উদ্যোগ বা শিল্পোদ্যোগ ধারণার উন্নয়নও ততই সামনে এসেছে। এখন উদ্যোগ ধারণা নতুন কিছু সৃষ্টির সাথে জড়িত যেখানে উদ্যোক্তা অনিশ্চয়তা মেনে নিয়ে নতুন পণ্য, ধারণা ও বাজার সামনে রেখে সফলতা লাভে অগ্রসর হন।